ওয়ার্ডপ্রেস কি? ওয়ার্ডপ্রেস কেন এত জনপ্রিয়?
একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে আপনি হয়ত ইতোমধ্যেই ওয়ার্ডপ্রেস শব্দটি শুনে থাকবেন। যদি না শুনে থাকেন তবুও আপনি হয়ত বহুবার ওয়ার্ডপ্রেস দ্বারা চালিত সাইট ভিজিট করেছেন- আপনার অজান্তেই! ওয়ার্ডপ্রেস হচ্ছে একটি কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সহজ ভাবে বললে “সফটওয়্যার”) যা দিয়ে ওয়েবসাইট নির্মাণ ও পরিচালনা করা হয়। চলুন জেনে নেয়া যাক, ওয়ার্ডপ্রেস কি, এর ইতিহাস ও ওয়ার্ডপ্রেস কেন এত জনপ্রিয়, ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত।
ওয়ার্ডপ্রেস কি? – What is WordPress in Bangla
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ওয়ার্ডপ্রেস হলো ওয়েবসাইট ও ব্লগ তৈরীর সবচেয়ে সহজ ও বহুল জনপ্রিয় মাধ্যম। ওয়ার্ডপ্রেস একটি ওপেন-সোর্স সিএমএস বা কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, যা পিএইচপি (PHP) প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।
ওয়ার্ডপ্রেস GPLv2 এর অধীনে লাইসেন্স করা ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার হওয়ার ফলে যেকেউ ওয়ার্ডপ্রেস বিনামূল্যে ব্যবহার ও মোডিফাই করতে পারে। বর্তমানে বিশ্বের সকল ওয়েবসাইটের প্রায় ৪০ শতাংশ ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে তৈরী!
ওয়েবসাইট তৈরীর কাজকে ওয়ার্ডপ্রেস সহজ করে দিয়েছে। ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে যেকেউ খুব সহজেই একটি ওয়েবসাইট তৈরী করতে পারবে। এছাড়াও ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে ওয়েবসাইট তৈরীতে কোনো প্রকার কোডিং সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলেও চলে।
WordPress.com নাকি WordPress.org?
গুগলে WordPress লিখে সার্চ করলে দুইটি ওয়েবসাইট শীর্ষস্থানে দেখতে পাবেন। এর মধ্যে একটি হলো WordPress.com ও অন্যটি WordPress.org সাইট। মজার ব্যাপার হলো, দুইটি ওয়েবসাইটের নামই WordPress হলেও কার্যক্রমের দিক দিয়ে এই দুইটি ওয়েবসাইটের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। চলুন সেই পার্থক্য সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
প্রথমেই কথা বলা যাক WordPress.org নিয়ে। এটি হলো ওয়েবসাইটের জন্য একটি ফ্রি ও ওপেন-সোর্স কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। অর্থাৎ ওয়ার্ডপ্রেস একটি সফটওয়্যার যা ব্যবহার করে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ওয়েবসাইট তৈরী করা যাবে। WordPress.org থেকে সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করে নিজের হোস্ট করা যেকোনো ওয়েবসাইট তৈরী করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনি একটি হোস্টিং সার্ভিস যেমন হোস্টগেটর, Bluehost, DijitalOcean, Vultr, Cloudways প্রভৃতি ব্যবহার করতে পারেন।
অন্যদিকে WordPress.com হলো মূলত একটি ওয়েব হোস্টিং কোম্পানি, যা WordPress.org এর সফটওয়্যার ব্যবহার করে টাকার বিনিময়ে ওয়েব হোস্টিং সেবা এবং ওয়েবসাইট তৈরীর সুবিধা দিয়ে থাকে। তবে WordPress.org এর আসল সফটওয়্যার সরাসরি প্রচলিতভাবে ব্যবহার না করায় WordPress.com এ কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
এই আর্টিকেলে আমরা ওয়েবসাইটের জন্য কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার ওয়ার্ডপ্রেস অর্থাৎ WordPress.org এ যেটা পাওয়া যায় সেটা নিয়ে জানবো।
ওয়ার্ডপ্রেস এর ইতিহাস
কলেজ শিক্ষার্থী ম্যাট মুলেনওয়েগ ২০০২ সালে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য b2/cafelog ব্লগিং সিস্টেম ইন্সটল করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ব্লগিং সিস্টেম এর প্রধান ডেভলপার কিছু কারণে এই ব্লগিং সিস্টেম এর কাজ বন্ধ করে দেন।
২০০৩ সালের এপ্রিল মাসের ১ তারিখে নিজের এক বন্ধু, মাইক লিটলকে নিয়ে b2/cafelog এর একটি নতুন সংস্করণ তৈরী করেন ম্যাট মুলেনওয়েগ। ম্যাট এর এক বন্ধু WordPress নামটির পরামর্শ দিলে নামটি তার পছন্দ হয় এবং সেই থেকেই জন্ম হয় ওয়ার্ডপ্রেস এর।
ওয়ার্ডপ্রেস এর প্রথম সংস্করণ, ওয়ার্ডপ্রেস ০.৭ ২০০৩ সালের মে মাসের ২৭ তারিখ মুক্তি পায়। ওয়ার্ডপ্রেস ১.০ প্রকাশ করা হয় ২০০৪ সালের জানুয়ারী মাসে। ওয়ার্ডপ্রেস এর এই সংস্করণ ‘Davis’ নামে পরিচিত। এরপর সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে ওয়ার্ডপ্রেসে যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন ফিচার ও বাড়তে থাকে ওয়েবসাইট তৈরীর সফটওয়্যার হিসেবে ওয়ার্ডপ্রেস এর জনপ্রিয়তা।
মূলত মুলেনওয়েগ ও মাইক লিটল এর প্রচেষ্টার ফসল ওয়ার্ডপ্রেস। যদিওবা ম্যাট মুলেনওয়েগ-ই ওয়ার্ডপ্রেস এর সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। এছাড়াও ম্যাট মুলেনওয়েগ WordPress.com এর পেছনে থাকা প্রতিষ্ঠান, Automattic এর প্রতিষ্ঠাতা।
ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইট
ওয়ার্ডপ্রেস এর যাত্রা একটি ব্লগ তৈরির সাধারণ টুল হিসাবে শুরু হলেও সময়ের সাথে সাথে বদলেছে ওয়ার্ডপ্রেস এর রুপ ও কার্যকারিতা। বর্তমানে ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে যেকোনো ধরনের ওয়েবসাইট তৈরী করা সম্ভব। এই ব্যাপারটি আরও সহজ হয়েছে ওয়ার্ডপ্রেস এর ডিরেক্টরিতে থাকা অসংখ্য থিম ও প্লাগিন এর সাহায্যে।
উদাহরণস্বরূপ, ওয়ার্ডপ্রেস শুধুমাত্র বিজনেস ওয়েবসাইট কিংবা ব্লগ তৈরীতেই নয়, বরং ই-কমার্স সাইট তৈরীরও অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে তৈরী করা সম্ভব এমন কিছু ধরনের সাইট নিম্নরূপঃ
- বিজনেস ওয়েবসাইট
- ই-কমার্স স্টোর
- ব্লগ
- পোর্টফোলিও
- রেজ্যুমে
- ফোরাম
- সোশ্যাল নেটওয়ার্ক
- মেম্বারশিপ সাইট, ইত্যাদি।
উল্লিখিত ধরনের ওয়েবসাইট ছাড়াও একাধিক ক্যাটাগরি মিশিয়েও ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইট বানানো যাবে৷ মোটামুটি ভাবা যায় এমন যেকোনো ধরনের ওয়েবসাইট ই ওয়ার্ডপ্রেস দ্বারা বানানো সম্ভব।
ওয়ার্ডপ্রেস এর ব্যবহারকারী কারা?
ওয়েবসাইট তৈরিতে ওয়ার্ডপ্রেস এর ব্যবহার এতোটাই জনপ্রিয় যে এটা ছাড়া বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে কল্পনাই করা যায় না। ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে এমন কিছু উল্লেখযোগ্য ওয়েবসাইট হলোঃ
- হোয়াইট হাউস এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইট
- মাইক্রোসফট এর অফিশিয়াল ব্লগ
- আমেরিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক, বিবিসি আমেরিকা
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্লগ, টেক ক্রাঞ্চ
- জনপ্রিয় শিল্পি, কেটি পেরি’র ওয়েবসাইট
- স্টার ওয়ারস এর অফিশিয়াল ব্লগ
- মিউজিক লেবেল, সনি মিউজিক
- দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস
- দ্যা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি
- এমটিভি নিউজ
- এবং আরো অনেক
ওয়ার্ডপ্রেস কেন এত জনপ্রিয়?
ওয়ার্ডপ্রেস এর জনপ্রিয়তার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক, কেন ওয়ার্ডপ্রেস এত জনপ্রিয়।
ফ্রি ও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার
ওয়ার্ডপ্রেস এর জনপ্রিয়তার কারণের মূলেই রয়েছে এটির সহজলভ্যতা। ফ্রি সফটওয়্যার হওয়ায় যেকেউ বিনামূল্যে ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে ওয়েবসাইট তৈরী করতে পারে। অন্যসব ওয়েবসাইট তৈরীর প্ল্যাটফর্ম মোটা অংকের টাকা দাবি করলেও সুলভ মূল্যে হোস্টিং ও ডোমেইন কিনে ওয়ার্ডপ্রেস এর সাহায্যে খুব সহজেই অল্প খরচে একটি ওয়েবসাইট তৈরী সম্ভব।
ব্যবহারে সুবিধা
জুমলা, ড্রুপাল, ইত্যাদির মত অনেক সিএমএস প্ল্যাটফর্ম থাকলেও এদের মধ্যে ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করাই সবচেয়ে সহজ। ওয়েবসাইট ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে কোনো পূর্বধারণা ছাড়াই যেকেউ খুব সহজেই ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে একটি ওয়েবসাইট তৈরী করতে পারবে। ব্লগ লেখা হোক কিংবা পেজ তৈরী, সকল কাজই ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে যেকেউ করতে পারে।
থিম
ওয়েবসাইট এর প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এর ডিজাইন। আর ওয়ার্ডপ্রেস চালিত ওয়েবসাইট ডিজাইন নির্ভর করে এর থিম এর উপর। ওয়ার্ডপ্রেস এর ডিরেক্টরিতে রয়েছে অসংখ্য ফ্রি থিম যা ব্যবহার করে আপনি যেকোনো ধরনের ওয়েবসাইট তৈরী করতে পারেন। ফ্রি থিম এর পাশাপাশি থিমফরেস্ট এর মতো মার্কেটপ্লেসে অনেক পেইড থিমস ও রয়েছে ওয়ার্ডপ্রেস এর জন্য।
প্লাগিন
ওয়ার্ডপ্রেস ইন্সটল করলে বেসিক সব ফিচার এর সাথেই পাওয়া যায়। তবে ওয়ার্ডপ্রেস এর ফাংশনালিটি উল্লেখযোগ্য হারে বর্ধিত বা উন্নত করতে চাইলে ব্যবহার করতে হয় ওয়ার্ডপ্রেস প্লাগিন। এগুলোকে অ্যাপ এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মোবাইলে যেমন বিভিন্ন অ্যাপ আপনাকে বিভিন্ন সুবিধা দেয়, তেমনি ওয়ার্ডপ্রেস প্লাগিনও সাইটে বিভিন্ন ফিচার যুক্ত করে।
ওয়ার্ডপ্রেস প্লাগিন ব্যবহার করে যেকোনো নতুন ফিচার যুক্ত করা সম্ভব ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইটে। এছাড়াও ওয়ার্ডপ্রেসে যেকোনো সমস্যার সমাধানেও প্লাগিন ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
এসইও
এসইও বা সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন এর ক্ষেত্রে ওয়ার্ডপ্রেস যথেষ্ট কার্যকর৷ ওয়ার্ডপ্রেস প্রথম থেকেই সার্চ ইঞ্জিন সমূহকে প্রাধান্য দিয়ে এসইও-বান্ধব সফটওয়্যার তৈরী করে আসছে। এর ফলে ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে তৈরী ওয়েবসাইটে গুগল থেকেই অসংখ্য ভিজিটর পাওয়া সম্ভব। এছাড়াও বিভিন্ন প্লাগিন ব্যবহার করে ওয়েবসাইটের এসইও কে উন্নত করা যায়।
সাপোর্ট
ওয়ার্ডপ্রেস ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার হলেও এই সফটওয়্যারকে ঘিরে রয়েছে বিশাল একটি কমিনিউটি। যার ফলে ওয়ার্ডপ্রেস সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যার সমাধান বের করা বেশ সহজ। এছাড়াও ওয়ার্ডপ্রেস অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ায় কোনো সমস্যা দেখা দিলে ব্লগ, ইউটিউব, ইত্যাদির কল্যাণে অল্প সময়েই সমস্যার সমাধান করা যায়।
ওয়ার্ডপ্রেস কিভাবে শিখবেন?
আমরা আগেই জেনেছি বিশ্বের একটি বিশাল সংখ্যার ওয়েবসাইট তৈরী হয় ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করেই। তাই ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েব ডিজাইনার ও ডেভলপার এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তাই ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার শেখার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
ওয়ার্ডপ্রেস শিখতে অন্যসব বিষয়ের মত ইউটিউবের সাহায্য নিতে পারেন। ওয়ার্ডপ্রেস কোডেক্স থেকেও ওয়ার্ডপ্রেস, ওয়ার্ডপ্রেস থিম ও ওয়ার্ডপ্রেস প্লাগিন ডেভলপমেন্ট সম্পর্কে সকল ধারণা লাভ করা সম্ভব।
এছাড়াও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রচুর ওয়ার্ডপ্রেস ব্লগ যা পড়েও আপনি ওয়ার্ডপ্রেস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন৷ আপনি যদি শুধুমাত্র ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েব ডিজাইনার হতে চান, সেক্ষেত্রে কোডিং না শিখেও ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইট ডিজাইন করতে পারবেন। তবে ব্যাক-এন্ড ডেভলপমেন্ট শিখতে হলে অবশ্যই পিএইচপি, এইচটিএমএল, জেকুয়্যেরি, জাভাস্ক্রিপ্ট, মাইএসকিউএল ইত্যাদি জানার প্রয়োজন হবে।
আমরা ভবিষ্যতে ওয়ার্ডপ্রেস নিয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল পোস্ট করব। আমাদের সাথেই থাকুন!
ডিসক্লেইমারঃ এই পোস্টে কিছু অ্যাফিলিয়েট লিংক থাকতে পারে যেখান থেকে আপনি প্রোডাক্ট কিনলে আমরা কিছু রেফারেল কমিশন পেতে পারি। তবে আমরা শুধুমাত্র মানসম্পন্ন প্রোডাক্ট/সার্ভিসই রেফার করি।